কাশ্মীর, ভুটান, আর সিকিমের সৌন্দর্যের সমকক্ষ যদি কোনো জায়গা ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য থাকে তাহলে তা নিঃসন্দেহে অরুণাচল প্রদেশ। বৈচিত্রে ভরপুর এই রাজ্য মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরা, আছে রহস্য আর একরাশ শান্তি। অরুণাচল প্রদেশকে বলা হয় ‘ভোরের আলোয় আলোকিত পাহাড়ের দেশ’, কারণ ভারতে সূর্যের আলো প্রথম পৌঁছোয় এখানে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের 7 সিস্টার্সের অন্যতম রাজ্য অরুণাচল প্রধানত ভুটান, তিব্বত এবং মায়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। ঝর্না, নদী , বরফ পাহাড়, সবুজ প্রান্তর সবকিছুই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এই স্থানগুলির সৌন্দর্য দূর্দান্ত, এবং আপনি অবশ্যই এই রাজ্যের প্রেমে পড়তে বাধ্য।
আগে অরুণাচল প্রদেশের অনেক জায়গায় কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে এখন সরকারি উদ্যোগের কারণে সেই জায়গাগুলোয় যাওয়া যায়, যার ফলে পারমিট পাওয়া আরও সহজ হয়েছে। যদি আপনি সত্যিই শান্তিপূর্ণ এবং সুন্দর একটি গন্তব্য খুঁজছেন, তাহলে অরুণাচল প্রদেশ আপনার ভ্রমণ তালিকার শীর্ষে থাকা উচিত। আমাদের বিশ্বাস, এখানে আপনার যে অভিজ্ঞতা হবে তা স্বর্গের চেয়ে কম কিছু নয়।
এই ব্লগে আমরা অরুণাচলের ৮টি দুর্দান্ত জায়গা সম্পর্কে আলোচনা করব যেখানে আপনার অবশ্যই যাওয়া উচিত ।
১. তাওয়াং (Tawang)
অরুণাচল প্রদেশের রাজকীয় হিমালয়ের মাঝখানে অবস্থিত, তাওয়াং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি পর্যটন কেন্দ্র। দলাই লামার জন্মস্থান এখানেই, যা আজ সাংইয়াং গ্যাতসো হিসাবে পরিচিত। দারুন প্রাকৃতিক দৃশ্য – বরফে ঢাকা শৃঙ্গ, আলপাইন তৃণভূমি এবং সৌন্দর্যে ভরা হ্রদ অঞ্চল – পর্যটকদের জন্য প্রকৃতির শান্তিতে একটি অন্যতম ঘোরার জায়গা। তাওয়াংয়ের প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য, যেখানে ভারতের বৃহত্তম বৌদ্ধ মঠ রয়েছে, যা ১৬৮০ সালে বা আনুমানিক ১৭ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রায় ৪৫০ জনের বেশি সন্ন্যাসী ধর্মচর্চা করেন। মন্যপা উপজাতির ঐতিহ্য, তাওয়াং যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, শান্ত লেক এবং গ্যাংগটসুম লেক এখানকার প্রধান আকর্ষণ।
২. বোমডিলা (Bomdila)

২,৪৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বোমডিলা, যেখানে তিব্বতি গুম্ফা, আপেলের বাগান এবং পর্বতমালা পর্যটকদের মুগ্ধ করতে বাধ্য। বোমডিলা মূলত অরুণাচলের কামেং জেলার একটা ছোট্ট শহর যা মেঘের আপন ঘর হিসেবে পরিচিত। মনোমুগ্ধকর চোখজোড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের বাইরে, বোমডিলা বিভিন্ন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দর্শনার্থীরা বৌদ্ধ এবং হিন্দু মন্দিরগুলি ঘুরে দেখতে পারেন, পাশাপাশি অত্যাশ্চর্য হিমালয়ের পাদদেশে ট্রেকিং এবং হাইকিং করতে পারেন। এখানকার থুবটেক মনেস্ট্রি অন্যতম একটি পুরোনো গুম্ফা, চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ অবধি বরফে ঢাকা থাকে তাই অনেক সময় রাস্তা বন্ধও থাকে, সেক্ষেত্রে বসন্তের ছুটিতে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। মনপা উপজাতির বাস এখানে। বোমডিলা ভ্রমণে আরও একটি দেখার জায়গা হলো লোকসংস্কৃতি মিউজিয়াম । এখানে অরুণাচলের বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, উৎসব ইত্যাদি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এক কথায় বোমডিলা অরুণাচল প্রদেশের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র তাই আপনার অরুণাচল প্রদেশের ভ্রমণের Itenary -তে এই জায়গাটি অবশ্যই রাখবেন।
৩. জিরো ভ্যালি (Ziro Valley)
জিরো ভ্যালি একটা শান্ত উপত্যকা যা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে প্রস্তাবিত। জিরো ভ্যালি মূলত অ্যাপাটানি উপজাতির জন্য পরিচিত। এখানকার বাঁশের ঘর, সবুজ ধানক্ষেত এবং বার্ষিক জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের। এই উপত্যকাটি অ্যাপাটানি উপজাতির আবাসস্থল হওয়ার জন্য, তাদের অনন্য সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্য গুলো আজও সংরক্ষণ করে রেখেছে। এই উপজাতির মহিলাদের নাকের বিশেষ অলংকার এবং পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রকাশ করে। এছাড়া, এখানকার হাইকিং ট্রেইল, স্থানীয় হস্তশিল্পের বাজার এবং পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় দর্শন আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
৪. সেলা পাস (Sela Pass)
অরুণাচল প্রদেশের আরেকটি সুন্দর এবং বিখ্যাত স্থান হল সেলা পাস। ১৩,৭০০ ফুট উচ্চতায় সেলা পাস সারা বছরই প্রায় তুষারে ঢাকা থাকে, যা হিমালয়ের এক প্রবেশদ্বার। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রকৃতির সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য উপহারগুলির মধ্যে একটি সেলা পাস, যা তাওয়াং জেলাকে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত করে। ইতিহাস বলছে – এটি ছিল প্রাচীন তিব্বতি ব্যবসায়ী পথের অংশ, যেখানে বণিকরা লবণ, মসলা এবং মূল্যবান সামগ্রী আদান-প্রদান করতেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল, যেখানে ভারতীয় সৈন্যরা সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এখানে পৌঁছানোর প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে মেঘের মেলা এবং সাদা বরফের চাদরে মোড়া রাস্তা। সেলা পাসের শীতল হাওয়া আর তুষারের স্তূপ ভ্রমণকারীদের জন্য এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। হয়তো এই কারণেই সেলা লেককে ‘স্বর্গের দরজা’ বলা হয়। সেলা পাস থেকে দেখা হিমালয়ের বিস্তৃত দৃশ্য আপনার মনকে মোহিত করবেই, আর সঙ্গে বরফের মাঝে প্রাচীন বৌদ্ধ মঠগুলিতে ঐতিহ্যের ছোঁয়া অনেকটা ঐ ’Cherry On The Top’ -এর মতো ।
৫. দিরাং (Dirang)
বোমডিলা থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথে ৪২ কিলোমিটার দূরে দিরাং- এর অবস্থান, যা অরুণাচলের একটি ছোট্ট সুন্দর জনপদ। দিরাং থেকে ১০কিমি দূরে বেড়িয়ে নেওয়া যায়, সাংতি ভ্যালি, Hot Spring, War Memorial, ইয়াক গবেষণা কেন্দ্র, চুগ ভ্যালি এবং বিভিন্ন মনাস্ট্রি। রয়েছে কালা চক্র মঠ – যা বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র স্থান, যা স্থানীয় সংস্কৃতির ধারক -বাহক বলা যায়, এবং দিরাং জং নামে পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এই পাহাড়ি দুর্গ যা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণের । এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য – উঁচু পাহাড়, সবুজ উপত্যকা, এবং স্বচ্ছ নদী, আর স্থানীয় তিব্বতি সংস্কৃতি আপনার ট্রিপকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
৬.ভ্যালুক পং (Bhalukpong)
এর পর যাওয়া যেতে পারে ভ্যালুক পং, অরুণাচল প্রদেশের আরও একটি মনোরম স্থান। যেখানে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে। অরুণাচলের উত্তর দিক থেকে নেমে আসা কামেং নদীর তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ। তেজপুর থেকে ৬০ কিলোমিটারের দূরত্বে ভ্যালুক পং-এর অবস্থান। নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকাবিহার, এবং নদীর শীতল জলে স্নান পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া, কাছেই রয়েছে পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বিখ্যাত সেংবিচা পাখি অভয়ারণ্য। কামিং নদীর তীরে ছোট ছোট পাহাড়শ্রেণী আর অন্যদিকে রয়েছে হালকা জঙ্গল। যা নামেরি ন্যাশনাল পার্ক নামে পরিচিত। এখানে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য রিভার রাফটিং-এর সুযোগও রয়েছে। আপনার ট্রাভেল itenary -তে এই জায়গাটা রাখতে ভূলবেন না।
৭. আনিনি (Anini)
দেবাং উপত্যকার কোলে অবস্থিত আনিনি, অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত এবং একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। মেঘে ঢাকা পাহাড়, সবুজ বনভূমি, এবং শান্ত নদী এই জায়গাটিকে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ করে তুলেছে । স্থানীয় ইদু মিশমি উপজাতি তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অন্যান্য উৎসবের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আরও গাঢ় করে তুলেছে। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার আর Untouched প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুইই একসাথে পেতে চান, তাহলে কথা দিচ্ছি, অনিনি আপানার জন্য স্বর্গরাজ্য। আপনি চাইলে দেবাং নদীতে মাছ ধরা, ট্রেকিং, এবং স্থানীয় গ্রামগুলিতে ঘুরে আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন। বিশেষ করে, এখানকার মায়ু গ্রাম এবং বিভিন্ন ছোট ছোট সেতু পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আনিনির শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং মনোরম দৃশ্য এখানে পর্যটকদের বারবার টেনে আনে।
৮. মেঘনারাম (Mechuka)
চিন সীমান্তের নিকটে অবস্থিত মেঘনারাম বা মেছুকা, এটি তার সবুজ উপত্যকা, শান্ত নদী এবং বৌদ্ধ গোম্ফার জন্য বিখ্যাত। মেঘনারামের সুমডোর মঠ, স্থানীয় আদিবাসী মেনপা উপজাতি, এবং তাদের সংস্কৃতি প্রত্যেক ভ্রমণকারীদের কাছে অজানা গল্পের মতো। প্রত্যেক বছর এখানে বার্ষিক মেছুকা ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় লোকজনের গান, নাচের পাশাপাশি এবং Handcrafted জিনিসের Exhibition হয়। মেঘনারামের অন্যতম আকর্ষণ হল ইয়াক রাইড, যেখানে পর্যটকরা স্থানীয় গাইডের সঙ্গে গেলে গোটা জায়গাটা ভালো করে Explore করতে পারবে। সিয়োম নদীতে কায়াকিং এবং রাফটিং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া স্থানীয় সব লোভনীয় তিব্বতি খাবার – যেমন মোমো, থুকপা – এগুলো কিন্তু অবশ্যই মিস করবেন না ।
সবশেষে বলি, অরুণাচল প্রদেশ – শুধু একটি রাজ্য নয়, অজানা প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক জীবন্ত জাদুঘর । এই ৮টি গন্তব্য শুধু ভ্রমণ নয়, বরং ঐতিহ্য, প্রকৃতি, এবং সংস্কৃতির এক অসাধারণ মিলনস্থল। তাহলে অপেক্ষা কিসের!
ব্যাগ গুছিয়ে নিন, পা বাড়ান আর Explore করুন অরুণাচলের অজানা সৌন্দর্যের জগৎ।
One Response
অপূর্ব। সত্যিই একটা মন ভালো করা লেখা।