একজন তীর্থযাত্রীর ডায়েরি থেকে…
ভোর পাঁচটা বাজে। চারধারে কুয়াশা, ঠান্ডার কামড় যেন হাড়ে গিয়ে বিঁধছে। ঘোড়া, খচ্চর আর পায়ে হাঁটা পথ — কেদারনাথ পৌঁছানোর রাস্তা যেমন কঠিন, তেমনি পবিত্র। কেদারনাথ — নামটা উচ্চারণ করলেই হৃদয়ে এক অপার্থিব অনুভূতি জাগে। বরফে ঢাকা পাহাড়, শান্ত পরিবেশ, আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন মন্দির, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে টানে এক অনন্য বিশ্বাসে। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত কেদারনাথ মন্দির, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি, যা প্রাচীনত্বে ভরপুর।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৫৮৩ মিটার উচ্চতায় (১১,৭৫৫ ফুট) মন্দাকিনী নদীর তীরে ও হিমালয়ের গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার অঞ্চলের কাছে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরীকুণ্ড থেকে ১৮ কিমি উপরে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত কেদারনাথ। যেখানে মুল মন্দিরে পৌছতে গেলে আপনার পক্ষে সড়কপথে বা যানবাহনে করে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব।
তাও অনেকেই স্বপ্ন দেখেন কেদারনাথ যাওয়ার, কিন্তু এমন একটা যাত্রা শুরু করার আগে শুধু মানসিক আর শারীরিক প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, সঙ্গে লাগবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্রও। তাই এই ব্লগে আমি শেয়ার করছি — কেদারনাথ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি নথিপত্রের তালিকা, আর সাথে থাকছে কিছু বাস্তব ভ্রমণ টিপস, যাতে ভবিষ্যতে কেদার যাত্রা করেলে এই প্রস্তুতি গুলি আগেই সেরে ফেলতে পারেন।

সরকারি নথিপত্র: যা আপনার সাথে থাকা আবশ্যক
বর্তমানে উত্তরাখণ্ড সরকার কেদারনাথ যাত্রাকে আরও সুরক্ষিত ও সুসংগঠিত করতে (UTDB) এবং চার ধাম যাত্রা গাইডলাইন অনুযায়ী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম আরোপ করেছে। তাই যাত্রা শুরু করার আগে আপনাকে অবশ্যই নিচের ডকুমেন্টস সাথে রাখতে হবে:
১. E- Registration /E-Pass :
- উত্তরাখণ্ড সরকার চালু করেছে “Tourist Care Uttarakhand” নামের একটি পোর্টাল/অ্যাপ, যেখান থেকে কেদারনাথ যাত্রার রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। রেজিস্ট্রেশনের পর একটা বারকোডসহ স্লিপ মেলে— এটা হারালে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। যাত্রার আগে অন্তত ২০ থেকে ৩০ দিন আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন https://registrationandtouristcare.uk.gov.in করতে হবে।
- প্রতিটি ভ্রমণকারীর জন্য একটি QR Code ইস্যু করা হবে, যেটি মোবাইলে বা প্রিন্টেড কপি রাখতে হবে।
২. পরিচয়পত্র (ID Proof):
- This is very much impotant point…রেজিস্ট্রেশন, হেলিপ্যাড বুকিং বা হোটেল চেক-ইন— সবেতেই লাগবে। আধার কার্ড / ভোটার কার্ড / ড্রাইভিং লাইসেন্স / পাসপোর্ট। সঙ্গে অবশ্যই রাখতে হবে একাধিক ফটোকপি।
- এটি চেকপয়েন্টে দেখাতে হতে পারে। মাঝে মাঝে নিরাপত্তার খাতিরে দ্বিগুণ যাচাই হয়। তাই Second ID option একটা রাখলে ভালো।
৩. COVID-19 ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট (প্রয়োজনে):
- যদিও বাধ্যতামূলক না হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটার প্রয়োজন হতেই পারে। তাই অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য সাথে রাখা ভালো।
৪. হেলথ সার্টিফিকেট (বিশেষ করে ৫০+ ও শিশুদের জন্য):
- উচ্চ পর্বত যাত্রা হওয়ায় ফিটনেস সার্টিফিকেট (স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে) অনেক ক্ষেত্রেই অনুরোধ করা হয়। সোনপ্রয়াগ বা গৌরীকুণ্ড থেকে চড়াই শুরু হওয়ার আগে অনেক জায়গায় মেডিকেল চেকআপ বাধ্যতামূলক। বয়স বেশি হলে বা শ্বাসকষ্ট/হৃদরোগ থাকলে এটা খুব জরুরি।
৫. ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স (ঐচ্ছিক হলেও গুরুত্বপূর্ণ):
- দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ— পাহাড়ে সবসময় ঝুঁকি থাকে। কিছু ট্র্যাভেল কোম্পানি ইনস্যুরেন্সসহ প্যাকেজ দেয় , যেমন আমাদের Travelzia তার মধ্যে অন্যতম। নিজের উদ্যোগেও ইনস্যুরেন্স করে নিতে পারেন।
কবে থেকে কেদারনাথ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে?
প্রতি বছর কেদারনাথ মন্দির এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে বা মে মাসের প্রথমে খোলা হয় এবং অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খোলা থাকে। এরপর শীতকালে বরফ পড়া শুরু হলে মন্দির সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। দিনের বেলায়, মন্দিরটি ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এরপর দুপুরের খাবারের জন্য বন্ধ হয় এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আবার খোলা থাকে।
কীভাবে পৌঁছাবেন কেদারনাথ?
সড়কপথে:
- হরিদ্বার বা ঋষিকেশ থেকে বাস/ট্যাক্সিতে / প্রাইভেট গাড়িতে গৌরীকুন্ড পৌঁছাতে হবে।
- গৌরীকুন্ড থেকে কেদারনাথ মন্দিরের পথটি পায়ে হেঁটে প্রায় ১৬ কিমি ট্রেক করতে হয়। ২০১৩ সালের বন্যার আগেকার পথটি এখন আগের অবস্থায় পরিবর্তন করা হয়েছে এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য এখন আরও নিরাপদ এবং সুবিধাজনকহয়ে গেছে।
হেলিকপ্টার পরিষেবা:

- যদি আপনি নিশ্চিত হন যে এই ট্রেকিং আপনার জন্য উপযুক্ত নয়, তাহলে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হল হেলিকপ্টার নেওয়া। গুপ্তকাশী / ফাটা / সিরসী থেকে কেদারনাথ পর্যন্ত হেলিকপ্টার পরিষেবা পাওয়া যায়। যেকোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গা আপনি বেছে নিতে পারেন।
- চাইলে অনলাইনে হেলিকপ্টার বুক করতে পারেন, যেখানে বুকিং সাধারণত এক মাস আগে থেকে শুরু হয় । heliservices.uk.gov.in
- যাদের হাঁটা সম্ভব নয় বা সময় কম, তাঁদের জন্য উত্তম।
খচ্চর / প্যালাকুইন:

- কেদারনাথের ১৬ কিমি ট্রেক রুট অনেকের কাছেই শারীরিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে প্রবীণ, ছোট শিশু বা যাঁদের হাঁটার সমস্যা রয়েছে। সেজন্য পাহাড়ি পথে এক পুরনো অথচ কার্যকর উপায় হল খচ্চর এবং ডোলি (প্যালাকুইন)। বিশ্বাস করুন সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই পরিষেবাগুলি শুধু সাহায্য নয়—পুরো ট্রিপটাকেই অনেক বেশি মানবিক ও স্মরণীয় করে তোলে।
- রুট: গৌরীকুণ্ড → কেদারনাথ
- সময় লাগে: প্রায় ৪–৫ ঘণ্টা কিংবা ৬–৭ ঘণ্টা
- খচ্চর যাত্রা খরচ: ₹2,500 – ₹3,500, ওজন ও সিজনের ভিত্তিতে ভিন্ন হতে পারে।
- ডোলি বা প্যালাকুইন যাত্রা (Doli / Palki Ride) খরচ : ₹6,000 – ₹10,000, ওজন ও ব্যক্তির বয়স অনুসারে।
কোথায় বুকিং করবেন?
- গৌরীকুণ্ড GMVN কাউন্টার – সরকারি রেট অনুযায়ী বুকিং হয়।
- অনলাইন/Pre-Booking: যদিও বেশিরভাগ বুকিং অনস্পট হয়, কিছু বেসরকারি পোর্টাল থেকে আগেভাগেই কুলি বা খচ্চর বুকিং করা যায়।
- স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্টরাও এই পরিষেবার ব্যবস্থা করে থাকেন।
কেদারনাথ যাত্রায় থাকার ব্যবস্থা
কেদারনাথ যাত্রার সময় থাকার জন্য প্রধানত দুই জায়গায় ব্যবস্থা করা যায়—গৌরীকুন্ড ও কেদারনাথ মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। গৌরীকুন্ডে বেশ কিছু বাজেট হোটেল, সাধারণ লজ এবং ধর্মশালার পাশাপাশি GMVN-এর (Garhwal Mandal Vikas Nigam) পরিচালিত রেস্ট হাউস পাওয়া যায়, যেখানে সরকারি নির্ধারিত ভাড়ায় নির্ভরযোগ্য পরিষেবা মেলে। অন্যদিকে, কেদারনাথ মন্দির চত্বরের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থাও আছে, যেখানে GMVN-এর Tent Accomodation ও Shared Dormitory রয়েছে। যদিও এখানে সুযোগ সীমিত এবং তবে বেসিক সুবিধাগুলি আপনি পেয়ে যাবেন। ভালো ও নিশ্চিন্ত থাকার জন্য যাত্রা শুরুর অন্তত ২০–৩০ দিন আগে থেকে বুকিং করে নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
কী কী সঙ্গে নেবেন?
- গরম কাপড় (জ্যাকেট, উলের টুপি, মোজা, গ্লাভস)
- ভালো Grip -এর ট্রেকিং জুতো
- রেইনকোট, ছাতা
- মেডিকেল কিট (First Ad, ব্যথার ওষুধ, উচ্চতা-জনিত অসুস্থতার জন্য Diamox
- টর্চ, ও Extra Power Bank সঙ্গে রাখুন।
- শুকনো খাবার (energy bars, dry fruits)
- ID, ট্র্যাভেল বুকিং-এর প্রিন্ট কপি/QR
শেষ কথায়…
এতটা দূর্গম পথ অতিক্রম করে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন আপনি কেদারনাথ মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছাবেন, তখন চোখে জল আসবেই। এতদিনের ক্লান্তি মুছে যাবে এক মুহূর্তেই। মনে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করবেন আর নিজের অজান্তেই বলে ফেলবেন… ‘’হর হর মহাদেব’’ ।
তাহলে এবার আপনার ব্যাগ গুছিয়ে ফেলুন, ডকুমেন্টস রেডি করুন আর এই বছরেই বেরিয়ে পড়ুন পবিত্র কেদার দর্শনে ।
এই ব্লগটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর নিচে আপনার প্রশ্ন/মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।
১. কেদারনাথ যাত্রার জন্য কোন কোন সরকারি নথিপত্র প্রয়োজন?
২. কোথা থেকে কেদারনাথ যাত্রার অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করব?
সরকার অনুমোদিত ওয়েবসাইট: https://registrationandtouristcare.uk.gov.in – এখানেই ePass ও ট্রাভেলার প্রোফাইল তৈরি করতে হয়।
৩. VIP দর্শনের জন্য আলাদা কোনো পাস লাগে কি?
৪. কেদারনাথ মন্দির কবে থেকে কবে পর্যন্ত খোলা থাকে?
সাধারণত এপ্রিল শেষ/মে মাসের শুরু থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। শীতের জন্য মন্দির বন্ধ হয়ে যায়।
৫. মোবাইল নেটওয়ার্ক সেখানে কাজ করে কি?
৬.কোন মাসে কেদারনাথ ভ্রমণ সবচেয়ে উপযুক্ত?
মে থেকে জুন ও সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর – এই সময় আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকে। বর্ষা মৌসুম (জুলাই-আগস্ট) এড়িয়ে চলা উচিত।
৭. যাত্রায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কী সাবধানতা নিতে হবে?.কোন মাসে কেদারনাথ ভ্রমণ সবচেয়ে উপযুক্ত?
উচ্চতা জনিত অসুস্থতা এড়াতে ধীরে ধীরে উঠুন, প্রচুর জল পান করুন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ (যেমন Dimox) সঙ্গে রাখুন। মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে ভুলবেন না।
Share Now
Latest Posts
- 26/07/2025