ভুটান ভ্রমণের আগে জেনে নিন প্রয়োজনীয় পারমিট ও বাজেট টিপস

পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা। সবুজের বুকে এ এক অদ্ভুত শান্তি… যেন সময় থেমে গেছে।”
এই অনুভূতি যদি আপনিও একবার পেতে চান, তাহলে আপনার পরবর্তী  গন্তব্য হতে পারে – ভুটান।

বিশ্বের প্রথম কার্বন ফ্রী দেশ ভুটান, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এক ছোট্ট রাজ্য, যাকে বলা হয় “Happiness Country”। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ, দারুণ অতিথিপরায়ণতা আর সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধনে ভরা এই দেশটি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তবে, ভুটান ভ্রমণে যাওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাটা খুব দরকারি – বিশেষ করে পারমিট, বাজেট এবং কয়েকটি রিয়েল ট্রাভেল হ্যাক।

গত এপ্রিল মাসে আমরা কয়েকজন মিলে চলে গিয়েছিলাম ভুটানের পাহাড়ের কোলে আমাদের অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করতে। তাই নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই আপনাদের এই ব্লগে কিছু Details জানিয়ে রাখতে চাই। 

কেন ভুটান?

ভুটান, হিমালয়ের কোলে একটা ছোট্ট রাজ্য — যেটা তার Gross National Happiness বা জাতীয় সুখ মডেলের জন্য বিখ্যাত। এখানে ট্রাফিক লাইট নেই, কিন্তু আছে পরিপাটি রাস্তা আর Discipline মানুষ। খুবই সাধারণ অথচ গভীর একটা জীবনযাত্রা। পার্বত্য সৌন্দর্য, বৌদ্ধ সংস্কৃতি আর প্রাণের মতো স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতি — সব মিলিয়ে ভুটান একেবারেই ‘Peace Lovers’ ও ‘Culture Seeker’-দের জন্য স্বপ্নের জায়গা।

ভুটান ভ্রমণের সেরা সময় কখন?

আমার মতে, মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর — এই দুই সময়টাই সবচেয়ে সেরা। তখন আবহাওয়া মনোরম, দৃশ্য অসাধারণ, আর পাহাড়ে হাঁটার জন্য একদম উপযুক্ত। জুন-আগস্ট বর্ষাকাল, তখন একটু বিপজ্জনকও হতে পারে।

ভুটানে ঢোকার জন্য পারমিট — জেনে রাখুন

 Entry Permit – মূল চাবিকাঠি

ভারতীয়, বাংলাদেশি এবং মালদ্বীপের নাগরিকদের জন্য ভিসা নয়, Entry Permit-ই সব কিছু। এই পারমিট পেতে হলে আপনার প্রয়োজন—

  • পাসপোর্ট (৬ মাসের মেয়াদ থাকতে হবে)
    অথবা
  • ভোটার আইডি কার্ড
  • ২ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি
  • শিশুদের জন্য Birth Certificate 


Entry Permit
পাওয়া যায়:

  1. ফুয়েন্টশেলিংয়ের বর্ডার ইমিগ্রেশন অফিস
  2. পারো এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন
  3. অনুমোদিত ভুটানি ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে (অনলাইন পারমিট)

Timing : সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা (১টা থেকে ২টা লাঞ্চ ব্রেক)

বিশেষ টিপস : Season Time -এ গেলে লম্বা লাইন হতে পারে। বায়োমেট্রিক ইনপুটের কারণে সময় একটু বেশি লাগবে।

Inner Line Permit (ILP) – প্যারো-থিম্পু ছাড়িয়ে ঘোরার চাবিকাঠি 

যদি আপনি হা ভ্যালি, পুনাখা, চেলে লা পাস ইত্যাদি দেখতে চান, তাহলে থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে ILP নিতে হবে। সপ্তাহের Working Days -এর মধ্যে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই পারমিট দেওয়া হয়। প্রয়োজন পড়বে আপনার Entry Permit-এর ফটোকপি। এক দিনের জন্য যারা শুধু ফুয়েন্টশোলিং ঘুরতে আসেন, তাদের পারমিট লাগে না। যারা পাসপোর্ট/ভোটার ID নেই, তারা Indian Consulate থেকে Identification Slip নিতে পারেন (প্যান/আধার/ড্রাইভিং লাইসেন্স + ছবি সহ)।

মোট বাজেট: ₹৩২,৬৩৯/- (৮ রাত/৯ দিনের জন্য)

জন প্রতি, ভারতীয় পর্যটকের জন্য, বাজেট ফ্রেন্ডলি ট্রিপ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছে।  সম্পূর্ন একটি Basic বাজেট ধারণা দেওয়া হয়েছে, আপনারা চাইলে পছন্দ অনুযায়ী কিছু কিছু পরিবর্তন করে নিতে পারেন কিংবা প্রয়োজনে থাকার খরচে পরিবর্তন হতে পারে। 

  • Permit ও SDF ফি (₹1200 × 8 nights): ₹9600
  • থাকা (Budget Hotel, ₹1200 × 8 nights): ₹9600
  • খাবার (₹400 × 9 দিন): ₹3600
  • লোকাল ট্রান্সপোর্ট ও সাইটসিয়িং: ₹5500 (একই থাকবে, কারণ অনেক গুলো জায়গা একই দিনে ঘোরা যাবে)
  •  গাড়ির পারমিট + গ্রিন ট্যাক্স: ₹700
  •  দর্শনীয় স্থান/মিউজিয়াম এন্ট্রি ফি: ₹2000 (প্রায়)
  •  পার্সোনাল এক্সপেন্স/শপিং: ₹3000 (যথাযথ শপিং ধরেই, যদিও এটা সবার ইচ্ছাধীন )
  •  ভুটান ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স: ₹1200 ( এটি খুবই জরুরি ও কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক) 
  •  জয়গাঁও থেকে পারো যাতায়াত: ₹2039

যদিও আমি এখানে  ট্রেন Fare বা  যদি কেউ প্লেনে যেতে চান তার জন্য Flight Fare -এর বাজেটা ধরি নি, তাই অবশ্যই আপনার সুবিধা অনুযায়ী কিসে যাবেন সেটা এই বাজেটে Include করতে ভুলবেন না। 

 ভুটানের সেরা দর্শনীয় স্থান 

Tiger’s Nest Monastery (Paro Taktsang)  

এক কথায় এই জায়গা ভুটানের গর্ব। পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা মঠ। 3000 মিটার উচ্চতার এই অত্যাশ্চর্য Monastery -এর বুকে Trekking করে ওঠাটা একটু কষ্টকর, কিন্তু পুরোটা যেতে পারলে  অসাধারণ !

Paro Dzong

এটা মূলত প্রাচীন দুর্গ যা এখনও প্রশাসনিক দপ্তর ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 Paro Museum (National Museum of Bhutan) 

আজও ভুটানের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলে।

Trashi Chho Dzong (Thimphu)   

রাজা এবং ধর্মীয় গুরুদের অফিস এখানেই! সন্ধ্যায় লাইটিং দেখে মনে হবে কোনো এক রাজপ্রাসাদ।

Bhutan Postal Museum

একদম আলাদা! এখানে আপনি নিজের ছবি দিয়ে ডাকটিকিট বানিয়ে ফেলতে পারেন!

Dochula Pass 

৩১৪০ মিটার উচ্চতায় ১০৮টি স্তূপ, সাথে অসাধারণ হিমালয়ের দৃশ্য।

Chele La Pass 

ভুটানের সবচেয়ে উঁচু গাড়ি চলার রাস্তা। এখানে দাঁড়িয়ে পুরো Paro Valley এবং Haa Valley দেখা যায়।

Haa Valley

কম জনবসতিপূর্ণ, কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গ। যারা অফবিট পছন্দ করেন, তাদের জন্য পারফেক্ট।

এর পাশাপাশি দেখে নিন, আমাদের আরও একটি ব্লগ – Top 7 Must-Visit Places in Bhutan for First-Time Travelers

কিছু  প্রয়োজনীয় Travel Guide

1. পারমিট প্রস্তুতি 

  • ভারতীয়, বাংলাদেশি ও মালদ্বীপের পর্যটকদের ভিসা লাগে না, কিন্তু Entry Permit ও ILP (Inner Line Permit) আবশ্যক।
  • জয়গাঁও-ফুয়েন্টশেলিং সীমান্ত দিয়ে গেলে সকাল ৮টায় পৌঁছনো ভালো, কারণ বায়োমেট্রিক + লাইনে সময় লাগবে।
  • ভ্রমণপূর্বে পাসপোর্ট/ভোটার আইডি ও ২টি পাসপোর্ট সাইজ ছবির ব্যবস্থা রাখুন।

2. ভুটানে “নো হর্ণ” কালচার

  • ভুটানে গাড়ির হর্ণ বাজানো নিষিদ্ধ।
  • স্থানীয় আইন ও পরিবেশের প্রতি সম্মান জানিয়ে চলুন।

3. ভুটান গাইডবিহীন নয় – ILP ছাড়া কিছু এলাকাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ

  • থিম্পু ও পারো পর্যন্ত Entry Permit যথেষ্ট হলেও, পুনাখা, হা ভ্যালি, ফোবজিখা যেতে হলে Inner Line Permit লাগবেই।
  • ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা করার সময় ILP-এর ব্যাপারটা মাথায় রাখুন। আর সঙ্গে অবশ্যই একজন Local Travel Guide -এর সাহায্য নিন। কারণ ভুটানের কিছু কিছু জায়গায় Guide -এর পরামর্শ ও সহযোগিতা সত্যিই প্রয়োজন। ভুটানের ইতিহাস, Culture, রীতি-নীতি একমাত্র ওখানকার মানুষরাই ভালো করে বলতে পারবেন।

4.  Sustainable Development Fee (SDF) আগাম বুঝে নিন

  • ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ₹1200/রাত দিতে হয় SDF বাবদ।
  • এটি আগে ধরা না হলে বাজেট প্ল্যানে বিশাল গ্যাপ পড়ে যেতে পারে।

5. নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে Permit ও Green Tax লাগবে

  • RSTA অফিস থেকে নিতে হবে Vehicle Permit। ফি ₹200/-
  • Rinchending Check Post-এর পর Indian গাড়ির জন্য Nu 4500/দিন Green Tax দিতে হয়।
  • গাড়ির সব ডকুমেন্টস, DL ও ইনস্যুরেন্স সাথে রাখুন।

6. Hiking/Trekking -এর জন্য Physical Fitness জরুরি

  • Tiger Nest Monastery -তে উঠতে প্রায় ৩ – ৪ ঘণ্টা হাঁটতে লাগে।
  • তাই হালকা ট্রেনিং শুরু করে দিন অন্তত যাওযার 4 সপ্তাহ আগে থেকে।

7. ইন্টারনেট কানেকশন সামান্য অসুবিধা হতে পারে

  • অনেক জায়গায় Net Slow বা একদমই নেই।
  • Bhutan SIM কার্ড কিনে নিতে পারেন (TashiCell বা B-Mobile)।
  • তবে প্ল্যানের দাম ও কভারেজ আগেই দেখে নিন।

8. স্থানীয় মুদ্রা (Ngultrum) ব্যবহার সুবিধাজনক

  • ভুটানে ইন্ডিয়ান রুপি (₹) চলে, তবে শুধুমাত্র ₹100 মূল্যের নোট পর্যন্ত।
  • তাই ভুটানি Ngultrum বদলে নেওয়া ভালো, বিশেষ করে ছোট বাজার বা গ্রামের দোকানগুলোতে।

এর পাশাপাশি দেখে নিন, আমাদের আরও একটি ব্লগ – 10 Things to Know Before Visiting Bhutan: The Kingdom of Happiness

শেষকথা – 

ভুটান এমন এক দেশ যেখানে প্রতিটা সকাল শুরু হয় প্রার্থনার ঘণ্টাধ্বনিতে, আর প্রতিটা সন্ধ্যা ঢেকে যায় রঙিন প্রার্থনা পতাকায়।

ভুটানের প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি নিঃশ্বাস আপনাকে ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যাবে – একটা অদ্ভুত শান্তিতে। আর যদি আপনি ট্র্যাভেল ভ্লগ বানাতে চান, তাহলে টাইগার নেস্ট, চেলে লা পাস বা থিম্পু জং – সব জায়গা নিখুঁত ফ্রেম! অনেকেই ভেবে নেন ভুটান গেলে High Price Hotel আর গাইড নিয়েই যেতে হবে। কিন্তু একটুখানি Research  আর স্মার্ট বুকিং করলেই আপনি  অল্প খরচেই কয়েকদিনের একটা দারুণ মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ করে আসতে পারেন! বাজেট ফ্রেন্ডলি মানেই কম আনন্দ নয়, বরং স্মার্ট আনন্দ। 

তাই আপনি যদি প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর আত্মিক শান্তির খোঁজে থাকেন — তাহলে ভুটান ভ্রমণ আপনার জন্যই।

ভিসা-ফ্রি এই স্বর্গীয় দেশে একবার ঘুরে এলে, বুঝতে পারবেন “Less is more” কীভাবে সত্যি হতে পারে!

এবার আপনি বলুন, “ভুটান কবে যাচ্ছেন?”

ব্লগটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না এবং আরও কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে Comment করতে পারেন। 

Share Now

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

Plan Your Trip